bengali literatureBiographypriyojanala blogরিয়াজুল ইসলাম

কাজী নজরুল ইসলাম এর জীবনের কিছু অজানা কাহিনী

কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে হয়তো অনেক কিছুই জেনে থাকতে পারেন এমনকি তাঁর সব অথবা দু’চার খানা উপন্যাস বা কবিতার বই পড়ে শেষও করেছেন  অথবা চাকরী প্রস্তুতির জন্য তাঁর সম্পর্কে বিভিন্ন বই পড়েছেন। কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে আপনার জানার আগ্রহের জন্যেই প্রিয়জানালার এই পোস্টে কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে অজানা কিছু তথ্য তুলে ধরা হলো-  

কাজী নজরুল ইসলাম নামটা সুন্দর না? অবশ্যই সুন্দর! কিন্তু জানেন কি এই নামটা  নজরুলের আসল নাম নয়! নজরুলের আসল নাম ছিল নজর আলী পরে নজরুল নিজেই তার নাম পরিবর্তন করে রাখেন কাজী নজরুল ইসলাম

Untold Story of Kazi Nazrul Islam

নজরুলের ডাক নাম কি ছিল ? সবাই বলবে দুখু মিয়া, কিন্তু তার আরও একটা ডাকনাম ছিল `ত্যাড়াক্ষ্যাপা`, ছোট বেলায় পাড়ার লোকজন এই নামেই তাকে চিনতো। 

নজরুলের বাবা যখন  মারা যায় তখন তার বয়স নয় বছর । বাবা মারা যাওয়ার কিছু দিন পর তারই  আপন চাচা বজলে করিমের সাথে তার মায়ের বিয়ে হয়, এই ব্যাপারটা সে মেনে নিতে পারেনি অভিমানে বাড়ী থেকে বের হয়ে যান ।

 

১৯১৪ সালের প্রথম দিকে কাজী রফিজুল্লাহ নামক এক দারোগার আশ্রয়ে চলে আসেন ময়মনসিংহ। দারোগা সাহেব তাকে ত্রিশালের দরিরামপুর হাইস্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। ১৯৬৪ সালে বিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে নজরুল একাডেমি করা হয়েছিল। ২০১৮ সালে এটি সরকারিকরন করা হয়। কাজী নজরুল ইসলাম এর মাধ্যমিক পরীক্ষার ঠিক আগে আগে শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, নজরুল ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে চলে যান করাচী । যুদ্ধের ময়দানে যাওয়ার প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্বেও যুদ্ধে আর যোগ দেয়া হয়নি তার, করাচীতেই আটক অবস্থায় কেটে যায় তার সৈনিক জীবন ।

করাচী বসেই লেখালেখি  শুরু করেন, ডাকযোগে লেখা পাঠাতেন কলকাতা সওগাত পত্রিকা অফিসে । কিছুদিন পর ফিরে আসেন কলকাতায়, অস্থায়ী ভাবে কয়েকটা বাসায় ছিলেন। নজরুলে এই অস্থায়ী সময়ের তত্বাবধায়ক ছিলেন বন্ধু মুজাফফর আহম্মদ

 

কলকাতায় পরিচয় হয় আকবর আলী খান নামে এক প্রকাশকের সাথে, তার সাথে কুমিল্লায় ঘুরতে এসে খান সাহেবের ভাগ্নি নার্গিস  খানমের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, কিন্তু বিয়ের অনুষ্ঠানের মধ্যে ঘর জামাই থাকা নিয়ে বিরোধের জের ধরে বাসর না সেরেই সেখান  থেকে পালিয়ে আশ্রয় নেন কুমিল্লা শহরের  বীজরা দেবী নামে এক ধনাঢ্য মহিলার বাসায়, অবশ্য বীজরা দেবীর সাথে পরিচয় হয় সেই আকবর আলী খানের মাধ্যমেই। বীজরা দেবীর বাসায় থাকা অবস্থায় নজরুল অসুস্থ হয়ে পরেন, বীজরা দেবীর জা’র মেয়ে আশালতা দেবী নজরুলের শুশ্রূষা করেন, নজরুল তার প্রেমে পরে যায় আশালতার নাম দেন প্রমীলা দেবী।

 

পরে প্রমীলার সাথে নজরুলের বিয়ে হয় । বিয়ের ব্যাপারটা বীজরা দেবী মেনে নিতে পারেনি, প্রমীলা আর তার বিধবা মা গিরিবালা দেবী কে বাসা থেকে বের করে দেন বীজরা দেবী, দুজনের  আশ্রয় হয় নজরুলের কাছে। ১৫ বছর পর নার্গিসের সাথে দেখা হলে তাদের মধ্যে আনুষ্ঠানিক ভাবে বিচ্ছেদ হয় ।

 

প্রমীলা দেবী  কি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিবারের কেউ ছিলেন?

 

প্রমীলা দেবীর পরিবারের সাথে রবীন্দ্রনাথের পরিবারের সামান্যতম সম্পর্কও ছিলনা। এমনকি প্রমীলার পরিবারকে রবীন্দ্র পরিবারের কেউ চিনত বলেও ইতিহাসে প্রমাণ নেই। রবীন্দ্রনাথের জমিদার পরিবারের কোন মেয়ে কোন মুসলমান স্বামী গ্রহণ করেছিলেন বলে ইতিহাসে প্রমাণ নেই। অন্যদিকে ঠাকুর পরিবারের সাথে নজরুলের যে সখ্য গড়ে উঠেছিল তা রবীন্দ্রনাথের মহানুভবতার জন্যই। একজন উদীয়মান কবি হিসেবে নজরুল ছিলেন যেমন রবীন্দ্র ভক্ত, তেমনি রবীন্দ্রনাথও ছিলেন নজরুলের নিষ্ঠাবান পৃষ্ঠপোষক ও প্রেরণাদাতা। ঠাকুর বাড়িতে নজরুলের ছিল অবাধ যাতায়াত। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সাথে নজরুলের সম্পর্ক যাই থাকুক নজরুলের স্ত্রী প্রমীলা দেবীর পরিবারের সাথে রবীন্দ্রনাথের পরিবারের সামান্যতম সম্পর্কও ছিলনা। এমনকি প্রমীলার পরিবারকে রবীন্দ্র পরিবারের কেউ চিনত বলেও ইতিহাসে প্রমাণ নেই। 

 

ব্যক্তিগত জীবনে নজরুল খুব অভাবী ছিলেন । বন্ধুদের কাছে  টাকা ধার করেই চলে যায় তার জীবনের উল্লেখযোগ্য একটা সময় । নজরুল তার বন্ধুদের কাছে যত চিঠি পাঠিয়েছেন তার বেশিরভাগই টাকা ধার চেয়ে । একবার গ্রামোফোন কোম্পানি HMV’র সঙ্গীত পরিচালনার কাজ পান নজরুল।  তারা বেশ ভালো পরিমাণ  টাকা দিত নজরুলকে, তখন নজরুল কিস্তিতে একটা গাড়ী কিনেন, ২ কিস্তি দেয়ার পর আর দিতে পারেনি।  পরে গাড়ী কোম্পানি গাড়ীটি ফিরিয়ে নিয়ে যান ।

 

নজরুলের হাতে যখন কিছু টাকা আসতে লাগল তখনই তার প্রিয়তমা স্ত্রী হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পরেন । তার শরীরের নিচের অংশ অনেকটা অবশ হয়ে যায় । শাশুড়ি গিরিবালা দেবী তার শুশ্রূষা করেন ।

 

নজরুল জীবনের সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা ছিল দ্বিতীয়  সন্তান বুলবুলের মৃত্যু। প্রথম সন্তান কৃষ্ণ মোহাম্মদ তিন মাস বয়সেই  মারা যান ।  বুলবুলকে হারিয়ে কবি শোকে কাতর হয়ে পরেন । যেদিন বুলবুল মারা যায় সেদিন নজরুলের বাগানে হাসনাহেনা ফুল ফোটে নজরুল হাসনাহেনা ঘ্রাণ অনুভব করে পুত্রশোক ভোলার চেষ্টা করেন ।

 

১৯৪২ সালের দিকে বেতারে অনুষ্ঠান করাকালীন সময়ে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পরেন নজরুল । এই অসুস্থতায় বাকশক্তি হারান তিনি । জুলাই মাসের দিকে তার অসুস্থতা সম্বন্ধে সুষ্পষ্টরূপে জানা যায়। দুরারোগ্য হওয়ায় দেশীয় চিকিৎসায় খুব একটা ফল পাওয়া যায়নি, আবার বিশ্বযুদ্ধ চলার কারনে বিদেশ নিতেও বিলম্ব হয় । ততক্ষণে যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে যায় । ১৯৪২ সালের শেষের দিকে হারান মানসিক ভারসাম্যও । চিকিৎসা করানোর মত আর্থিক সামর্থ্য ছিল না কবি পরিবারের ।  নজরুলের চিকিৎসার আর্থিক সহযোগিয়তার জন্য গঠিত হয়  নজরুল চিকিৎসা কমিটি

 

উমা মুখার্জি, এক মহীয়সী মহিলার নাম । কবি অসুস্থ থাকাকালীন তাকে সেবা করার জন্য নার্স হিসাবে উমাকে নিয়োগ দেয়া হয়। ওদিকে প্রমীলা দেবীও তখন  ছিলেন অসুস্থ । উমা মুখার্জি কবির খাওয়া দাওয়া থেকে শুরু করে যাবতীয় সব বিষয় দেখাশোনা করতেন । পরবর্তীতে নজরুলের বড় সন্তান কাজী সাব্যসাচির সাথে উমার বিয়ে হয় । বিয়ের পরে উমা মুখার্জি হয়ে যান উমা কাজী । উমা কাজী আমৃত্যু কবির সেবা করে গেছেন ।

কাজী নজরুল ইসলাম ও উমা কাজী

উমা কাজী ও নজরুল ছবি thewall

  নজরুলের মৃত্যুর কিছুদিন পরেই ১৯৭৯ সালে কাজী সাব্যসাচিও মারা যান । পরে উমা কাজী সহ কবি পরিবারের বাকি সদস্যরা বনানিতে বসবাস করতে থাকেন । ২০২০ সালের ১৫ জানুয়ারি রাতে উমা কাজী পরলোকগত হন।

 

১৯৬২ সালের ৩০ জুন প্রমীলা দেবী মারা যান। প্রমীলার মৃত্যুর পর নজরুলের দুই সন্তান অরিন্দম এবং অনিরুদ্ধ জানান তার মা বলে গেছেন তাকে যেন ইসলাম ধর্ম মতে নজরুলের গ্রামের বাড়ি চুরুলিয়ায় দাফন করা হয় । সেই মোতাবেক তাকে তার ইচ্ছা অনুসারে দাফন করা হয় ।

 

 বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর সরকারের প্রচেষ্টায় কবিকে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়।

 

কাজী নজরুল কে বরন করে নিচ্ছেন বঙ্গবন্ধু

কাজী নজরুল কে বরন করে নিচ্ছেন বঙ্গবন্ধু

 

২৪ মে ১৯৭২ সালে  রাষ্ট্রীয়ভাবে তাকে জাতীয় কবির মর্যাদা দেওয়া হয়।সরকারের পক্ষ থেকে কবির জন্য ধানমন্ডিতে একটি বাড়ি বরাদ্ধ দেয়া হয় । বাড়ী টা তার খুব পছন্দের ছিল।  কিছুদিন পর অসুস্থতা  বাড়ার  কারণে  তাকে পিজি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় সেখানেই ১ বছরের মত চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় ১৯৭৬ সালের ২৯শে আগস্ট ইন্তেকাল করেন ।  

কাজী নজরুল ইসলাম এর জীবনের কিছু অজানা কাহিনী


 কাজী নজরুলের মৃত্যুর সংবাদে তাৎক্ষনিক উপস্থিত হন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান

কবির জানাজায় ১০ হাজারের মত মানুষ হয় তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এবং প্রধানমন্ত্রী আবু সায়েম চৌধুরি জানাজায় অংশগ্রহণ করেন

 তথ্য সূত্র

– আমারে দেব না ভুলিতে – আশীফ এন্তাজ রবি– কাজী নজরুল স্মৃতিকথা – মুজাফফর আহম্মদ– প্রথম আলো– উকিপিডিয়া– হযবরল ডট কম– thewall.inএশিয়াটিক সোসাইটি  Nazrul’s humanist vision- মাহমুদুল হাসান হিমেল

 লিখেছেন- রিয়াজুল ইসলাম (প্রিয়জানালা) 

 ক্রিকেট, ফুটবল, বাংলা সংবাদ, হেলথ টিপস, টেকনোলোজি টিপস, বাংলা ব্লগ, বিভিন্ন তথ্যমূলক প্রতিবেদন, পড়াশুনা সহ  নতুন সিনেমা/নাটক/ওয়েব সিরিজ সংবাদ/ বাংলা রিভিউ/গল্প ব্যাখ্যা/বাংলা সাবটাইটেল পেতে আমাদের ফেইসবুক পেইজের সাথে থাকুন-

প্রিয়জানালা ফেইবুক পেইজ  – ক্লিক করে লাইক দিন!

Back to top button