healthtipspriyojanala blog

বয়ঃসন্ধিকালঃ কিশোর কিশোরীদের বয়ঃসন্ধিকালীন পরিবর্তন ও করনীয়

 বয়ঃসন্ধিকালীন পরিবর্তন

একটি শিশু জন্মাবার পর থেকেই ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। একটা বয়সে দেখা যায় যে হঠাৎ তার মধ্যে দ্রুত ও অন্যরকম কিছু পরিবর্তন হচ্ছে যেমন: গলার স্বর পরিবর্তন হওয়া, হঠাৎ বেশ কিছুটা লম্বা হওয়া, শরীরের বিভিন্ন জায়গায় চুল গজানো ইত্যাদি। এই সময় তাদেরকে আর বাচ্চা বলা যায়না, আবার তাদেরকে পুরোপুরি বড়দের দলেও ফেলা যায় না।

এই সময়টা কে বয়ঃসন্ধিকাল বা কৈশোরকাল বলে ; অর্থাৎ শিশুকালের পরে প্রাপ্তবয়স্ক হবার আগে মাঝামাঝি যে সময়টা তাই হচ্ছে বয়ঃসন্ধিকাল বা কৈশোরকাল। বয়ঃসন্ধিকাল ইংরেজি তে Puberty বলা হয়। 

বয়ঃসন্ধিকালঃ কিশোর কিশোরীদের বয়ঃসন্ধিকালীন পরিবর্তন ও করনীয়
Stages of Puberty: what happens to boys and girls -Bangla 

 

বয়ঃসন্ধিকাল কখন শুরু হয়?

বয়ঃসন্ধিকাল সাধারণত: ছেলেদের ক্ষেত্রে ১৩ বছর এবং মেয়েদের ক্ষেত্রে ১০ প্লাস বছর বয়স থেকে শুরু হয়। এই বয়সন্ধিকালের পরিবর্তনগুলো পূর্ণতা পেতে আরো পাঁচ বছরের মতো সময় লাগে। তবে এই বয়সের সময় বিভিন্ন জনের বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন রকম হতে পারে।

 

বয়ঃসন্ধিকালে শারীরিক পরিবর্তন:

বয়ঃসন্ধিকালের শারীরিক পরিবর্তন বলতে বোঝায় দেহের পরিবর্তন, যেমন দ্রুত লম্বা, হওয়া শরীরের বিভিন্ন জায়গায় লোম গজানো ইত্যাদি। ও মানসিক পরিবর্তন বলতে বোঝায় মন মানসিকতা,মেজাজ ও আবেগের পরিবর্তন হওয়া।

ছেলে এবং মেয়ে উভয়ের ক্ষেত্রে কিছু শারীরিক পরিবর্তন শরীরের বাইরে হয় যা সহজেই দেখা যায়। আবার আবার কিছু পরিবর্তন হয় তা বাইরে থেকে দেখা যায় না। প্রজননতন্ত্রের পরিপক্কতা যা বাইরে থেকে দেখা যায় না। কিন্তু নানা ভাবে বোঝা যায়। বাইরে যেসব পরিবর্তন আমরা দেখতে পাই সেগুলো ভেতরের পরিবর্তনের ফলেই ঘটে । বাইরের এবং ভেতরের পুরো পরিবর্তনের ধারা কে বলে বয়ঃসন্ধি। আবার মেয়েদের  এবং ছেলেদের ক্ষেত্রে ক্ষেত্রে আলাদা কিছু পরিবর্তন হয়

ছেলেদের শারীরিক পরিবর্তন:

বয়ঃসন্ধিকালে হরমোনের প্রভাবে ছেলেদেরও অনেক পরিবর্তন হয় তবে মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের পরিবর্তন একটি দেরিতে শুরু হয়। সাধারণত: ছেলেদের পরিবর্তন শুরু হয় ১৩/১৪ বছর বয়সে এবং এর জের চলতে থাকে ১৭/১৮ বছর বয়স পর্যন্ত। এই সময় ছেলেদেরগলার স্বর ভেঙ্গে যায় ও ভারী হয়ে যায়, দ্রুত ওজন ও উচ্চতা বাড়ে, ব্রণ হয়, বুক ও স্তনের বোঁটা কিছুটা বৃদ্ধি হয়, বগলতলায় চুল গজায়, লিঙ্গের গোড়ায় চারপাশে চুল গজায়, হাতে, পায়ে, বুকের লোম উঠে, গোঁফ দাড়ি গজায়, অন্ডকোষ ও লিঙ্গ বৃদ্ধি পায়। অনিচ্ছাকৃত বীর্যপাত হয়, বুক ও কাধ চওড়া হয়, হাত ও পা পেশীবহুল হয়, শরীরের শক্তি বৃদ্ধি পায়, সব স্থায়ী দাঁত উঠে যায়, ঘাম বেশি হয় ইত্যাদি ।

মেয়েদের শারীরিক পরিবর্তন: 

মেয়েদের ক্ষেত্রে- দ্রুত ওজন ও উচ্চতা বৃদ্ধি পায়, স্তন বড় হয়/বুক পুষ্ট হয়, পায়ের লোম গারো হয়, বগলতলায় চুল গজায়, নিতম্বের হাড় চওড়া হয়, কোমর সরু হয়, উরু/রান ভারী হয়। শরীরের আকৃতি পরিবর্তন হয় যেমন শিশু থেকে তরুণী হয় ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে মেদ জমা হয়, যৌনাঙ্গ বড় হয়, ঘাম বেশি হয়, গলার স্বর একটু ভারী হয়, ব্রণ হয়, মাসিক হয় ইত্যাদি।

বয়ঃসন্ধিকালে মানসিক/আবেগগত  পরিবর্তন:

বয়ঃসন্ধির সময় নানা ধরনের শারীরিক পরিবর্তনের ফলে ছেলে-মেয়েদের মনে নানা প্রশ্ন, দ্বিধা,দ্বন্দ্ব, বিহ্বলতা দেখা দেয় ও মনের জন্য ভাব জন্মায়। এই সময়ে ছেলে ও মেয়ে উভয়েই নিজেদের শরীর, চেহারা, পোশাক, আচার-আচরণ ইত্যাদি সম্বন্ধে সচেতন হয় এবং প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই মেয়েরা ছেলেদের প্রতি ও ছেলেরা মেয়েদের প্রতি আকৃষ্ট হয়। হরমোন বা মস্তিষ্কের পিটুইটারি গ্ল্যান্ড নিঃসৃত এক প্রকার প্রাণী দেহ রস এর প্রভাবে বয়ঃসন্ধিকালে ছেলে-মেয়েদের যৌন বিষয়ে চিন্তা করার প্রবণতা, আকাশ-কুসুম চিন্তা করার প্রবণতা দেখা দেয় তার ফলে যৌন উত্তেজনা হয়ে থাকে। এই সময় ছেলে-মেয়েদের মন মেজাজ ঘনঘন পরিবর্তন হয়ে থাকে, যেমনঃ অল্পতেই খুশি হয় বা দুঃখ পায়। তাছাড়া লাজুক ও আত্মকেন্দ্রিক হয় অথবা অনেক বন্ধু-বান্ধব হয়, আত্ম সচেতনতা বৃদ্ধি পায়, আত্মনির্ভরশীল হওয়ার চেষ্টা করে ও সব বিষয়ে স্বাধীনতার দাবি করাটা বয়ঃসন্ধিকালের স্বাভাবিক আচরণ বা ধর্ম।

বয়ঃসন্ধিকালের শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের কারণ-

বয়ঃসন্ধিকালের পরিবর্তন হওয়াটাই স্বাভাবিক। এই বয়সে মানুষের মস্তিষ্কের পিটুইটারি গ্ল্যান্ডের কিছু হরমোন তৈরি হয়। এই হরমোন রক্তে সাথে মিশিয়ে সারা শরীরের চলে যায় এবং বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গুলোকে সক্রিয় করে তোলে। এই হরমোনের প্রভাব এই ছেলে এবং মেয়েদের মধ্যে নানারকম পরিবর্তন ঘটে। বয়ঃসন্ধিকালের ছেলে ও মেয়েদের মধ্যে যে সকল মানসিক পরিবর্তন দেখা যায় তা হল ভাবাবেগের বা মুড-এর দ্রুত পরিবর্তন হয়, যেমনঃ এই খুশি এই রাগ হওয়া। তারা না বাচ্চা না বড় হওয়ায় তাদের অনেক আচরণই বিরক্তিকর বলে মনে হতে পারে। বয়ঃসন্ধিকালে ছেলে-মেয়ে উভয়ের বড়দের সাথে মনোমালিন্য দেখা দেয়, সমঝোতায় আসতে অসুবিধা হয় , ছেলে-মেয়েদের একরোখা আচরণ যেমন বড়দের কাছে গ্রহণীয় হয় না, তেমনি বড়দের চাপিয়ে দেওয়া আদর্শ কৈশোরকালে বোঝা বলে মনে হয়। এই সময় বড়দের ও কিশোর-কিশোরীদের অর্থাৎ দুই পক্ষই আরও উদার হতে হবে পরিবর্তনের ধারা কে মানতে হবে। এই পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য কিশোর-কিশোরীদের বাবা-মার সাথে গভীর ও খোলামেলা সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। বয়ঃসন্ধিকালে ছেলেরা ভীষণভাবে আকর্ষণবোধ করে মেয়েদের প্রতি এটা স্বাভাবিক। ছেলেদের শিখতে হবে মেয়েদের শ্রদ্ধা করা সম্মান দেখানো ও মেয়েদের দুর্বল ভেবে তাদের ওপর বল প্রয়োগ না করা । ছেলে মেয়েদের প্রতি যৌন আকর্ষণ বোধ করা খুবই স্বাভাবিক তবে বড় হওয়ার সাথে সাথে একটি ছেলে শিখতে হবে কিভাবে আবেগ ও শারীরিক চাহিদা কে দমন করা যায়। মনে রাখতে হবে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারাটাই হচ্ছে বড় হওয়ার একটি অংশ।

 

বয়ঃসন্ধিকালের বিশেষত্ব কি?

মানুষের জীবনে এটি একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ সময়। কারণ শিশু বয়স থেকে বড় হয়ে ওঠার এটাই হচ্ছে প্রথম ধাপ। এ সময় দুটি পরিবর্তন ঘটে-শারীরিক পরিবর্তন এবং মানসিক পরিবর্তন। শারীরিক পরিবর্তন নির্ভর করে পারিবারিক কারণের ওপর অর্থাৎ জেনেটিক অর্ডারের ওপর আবার কখনো কখনো এর ব্যতিক্রমও থাকে। মানসিক পরিবর্তন বেশিরভাগ সময় নির্ভর করে পরিবেশের উপর। অর্থাৎ বাড়ির পরিবেশ এবং আর্থসামাজিক অবস্থা অধিকাংশ শিশুর বেড়ে ওঠার উপর বিশেষভাবে প্রভাব ফেলে।

বয়ঃসন্ধিকালের যা মনে রাখতে হবে

বয়ঃসন্ধিকালের ছেলে মেয়েদের মনে রাখতে হবে তাদের শরীর দ্রুত বাড়ছে সেই জন্য তাদের প্রচুর পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে । তবেই শরীরের বিভিন্ন অংশের বৃদ্ধি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হবে। তাছাড়া ব্যক্তিগত পরিষ্কার পরিছন্নতা পালন করা অত্যন্ত জরুরি। নিয়মিত গোসল করতে হবে যাতে শরীরে ঘামের গন্ধ না হয়। ধুলাবালি লেগে লোম কূপগুলি বন্ধ হয়ে না থাকে। মুখে ব্রণ হলে নিয়মিত সাবান দিয়ে মুখ পরিষ্কার করতে হবে। কৈশোর কালের ত্বকে আলাদা একটা সজীবতা, চাকচিক্য থাকে। সুতরাং কৃত্রিম রং দিয়ে ত্বকের স্বাভাবিক সৌন্দর্যকে ঢেকে ফেলা কোন প্রয়োজন হয় না। তাছাড়া নিয়মিত নখ কাটতে হবে চুল পরিষ্কার করতে হবে ,  দাঁত মাজতে হবে ও প্রচুর পরিমাণে দৌড়ঝাঁপ খেলাধুলা ব্যায়াম ইত্যাদি করতে হবে।

এ সময় সাবধানে চলাফেরা করতে হবে। সবার সামাজিক পরিবেশ তো এক নয়, সে কারণে যদি জীবনে চলার পথে কোন যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে যাও তখন কিন্তু হতাশা  ভেঙে পড়লে চলবে না। এর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। মনে রাখতে হবে মানুষের জীবন এইসব ঘটনার চাইতেও অনেক বড়। তাই জীবনকে সম্মান করা শিখতে হবে।

উঠতি বয়সে মেয়েদের জন্য কিছু কথা জেনে রাখা ভালো, আজকাল বহু কিশোরীদের পড়াশোনা, চাকরির জন্য বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাফেরা করতে হয়। এই সময় অনেক লোকের সাথে তাদের মিশতে হয়। এদের মধ্যে বহু মানুষ তোমাদের সাথে বন্ধুত্ব করতে চাইবে, কখনো তোমার বন্ধু হিসেবে, কখনো তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে মিশতে

চাইবে। মনে রেখো, মেয়েদের একটা মূল্যবান জিনিস আছে, এটা হল তার শরীর, এই শরীরের প্রতি অনেকেরই চোখ আছে। তোমার মনে হতে পারে ওরা তোমার বন্ধু, তোমার কোন ক্ষতি করার মনোভাব ওদের নেই, কিন্তু তারা তোমার অনেক কিছুই করতে পারে। তোমার সরলতার সুযোগ নিয়ে তোমার খুবই কাছের মানুষ হয়ে, আমার শরীরকে ব্যবহার করবে, যেটি তুমি নিজের থেকেই দিতে চাইবে। শারীরিক সম্পর্ক হয়ে যাওয়ার পর তোমার উপর থেকে আকর্ষণ কমে আসবে। আবার তোমার বন্ধুটি হয়তো নতুন শিকারের জন্য প্রস্তুত নিতে থাকবে

তাই আমি মনে করি বয়ঃসন্ধিকালে মেয়েদের ছেলেদের চাইতে অনেক বেশি সতর্ক হওয়া উচিত। মনে রাখা প্রয়োজন, মেয়েরা সেই মূল্যবান সম্পদের মালিক, যার নাম জরায়ু, জরায়ুর কারণেই সে মা হওয়ার ক্ষমতা রাখে, কখনোই তাকে অন্যের ইচ্ছায় চলতে দেওয়া ঠিক না।

লেখিকাঃ – আইরিন পারভীন, উন্নয়নকর্মী।    

আমাদের ফেইসবুক পেইজ- প্রিয়জানালা

https://www.facebook.com/priyojanala

 

 Stages of puberty: what happens to boys and girls

 

Back to top button