বাঘ – জানুন বাঘ সম্পর্কিত অজানা তথ্য Types of Tiger
বাঘ – পৃথিবীতে কত ধরনের বাঘ আছে জানুন
বাঘ সম্পর্কে আমরা বাঙালিরা কম বেশি অনেক কিছুই জানি। বরং কেও যদি না জানে, তাহলে আমরা বেশ অবাকই হবো। কেননা বাঘ আমাদের জাতীয় পশু। ছোটবেলা থেকেই আমরা বাঘ নিয়ে কতো গল্প-কাহিনী শুনে এসেছি। তবে, প্রশ্নটা হলো এই পৃথিবীতে কত ধরনের বাঘ আছে? চিতাবাঘ, চিতা, লিওপার্ড এগুলো কি বাঘ না সিংহের মতো আলাদা জাতি? আবার সিংহ সহ সকল বাঘ কি একই পরিবারের? জানতে ইচ্ছে হয় না?
আস্সালামু আলাইকুম আজ আমি আপনাদের কাছে পৃথিবীর যত বাঘ আছে যাদের বৈজ্ঞানিক নাম প্যান্থারা টিগ্রিস (Panthera Tigris), তাদের সম্পর্কে আলোচনা করবো। সবচেয়ে আশ্চর্য হবেন যখন শুনবেন বাঘে আর সিংহে প্রজননের ফলে নতুন হাইব্রিডও সম্ভব।
আরর্টিকেলে যা যা থাকছে
1. বাঘের বৈজ্ঞানিক পরিচিতি এবং তার পরিবারের সদস্য
2. পৃথিবীতে বিদ্যমান বাঘ
· বেঙ্গল টাইগার
· সাইবেরিয়ান বাঘ
· দক্ষিণ চীনা বাঘ
· ইন্দো-চীনা বাঘ
· সুমাত্রান বাঘ
· মালায়ান বাঘ
3. পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া বাঘ
· কাপ্সিয়ান
· জাভা বাঘ
· বালি বাঘ
4. প্রাগৈতিহাসিক ফসিল
5. হাইব্রিড বাঘ
6. মিউটেন্ট বাঘ
7. বাঘ কি মানূষ খেতে পছন্দ করে?
8. কেন এরা বিলুপ্তির পথে?
9. বাঘ সংরক্ষণে বিভিন্ন দেশের ব্যবস্থা
10. উপসংহার
বাঘের বৈজ্ঞানিক পরিচিতি এবং তার পরিবারের সদস্য
আমরা প্রানীরা সবাই অ্যানিমেলিয়া রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত। মেরূদন্ডী প্রানী হিসেবে কর্ডাটা পর্বের অন্তর্ভূক্ত। স্তন্যপায়ী প্রানী হিসেবে আমরা ম্যামালিয়া শ্রেণির অন্তর্ভূক্ত। তবে আমাদের সাথে বাঘের দৌড় এতটুকুই। এর পর থেকে বাঘ কার্নিভোরা বর্গে চলে যায়। এই বর্গের সকল প্রানীই হিংস্র হয়। এরপর এদের উপবর্গ হলো ফেলিফর্মিয়া। বাঘ ফেলিডে পরিবারের অন্তর্ভূক্ত। এর উপপরিবার থেকে এরা বিশেষ করে ভাগ হতে থাকে। নিচে এদের উপপরিবার থেকে শুরু করে প্রজাতি পর্যন্ত কত ধরনের প্রানী আছে তার একটি তালিকা নিচে দেওয়া হলোঃ
জগৎঃ অ্যানিমেলিয়া
পর্বঃ কর্ডাটা
শ্রেণিঃ ম্যামালিয়া
বর্গঃ কার্নিভোরা
উপবর্গঃ ফ্যালিফর্মিয়া
পরিবারঃ ফেলিডে
উপপরিবারঃ
1. ফেলিনে
· ওসিলট
· বুনো বেড়াল
· কওগার
· চিতা
2. প্যানথারিন
· জেগওয়ার
· লিওপার্ড
· সিংহ
· বাঘ
· তুষারে লিওপার্ড
· ক্লাওডেড লিওপার্ড
গণঃ প্যানথারা
প্রজাতিঃ প্যানথারা টিগ্রিস
পৃথিবীতে বিদ্যমান বাঘ
পৃথিবীতে সবমিলিয়ে ৪,৫০০-৫,৫০০ এর মতো বন্য বাঘ রয়েছে, যারা চিরিয়াখনায় থাকে না। তাও এই সংখ্যার প্রতিবেদনগুলো এক এক দেশে তিন থেকে ছয় বছর আগে দাখিল করা হয়েছে। বর্তমানে এদের সংখ্যা আরো কম হতে পারে। পৃথিবীতে এই ছয় প্রজাতির বাঘ পাওয়া যায়। নিচের ছকে কোন দেশে কতটি বাঘ আছে তা দেখানো হলোঃ
দেশ | বছর | সংখ্যা |
ইন্ডিয়া | ২০১৯ | ২,৬০৩- ৩,৩৪৬ |
রাশিয়া | ২০১৬ | ৪৩৩ |
চীন | ২০১৬ | ৩৪ |
ভিয়েতনাম | ২০১৬ | ৫ |
লাওস | ২০১৬ | ১৪ |
কম্বোডিয়া | ২০১৬ | ০ |
থাইলেন্ড | ২০১৬ | ১৮৯ |
মালেশিয়া | ২০১৪ | ২৫০-৩৪০ |
মিয়ানমার | ২০১৪ | ৮৫ |
বাংলাদেশ | ২০১৪ | ৩০০-৫০০ |
ভুটান | ২০১৫ | ৮৯-১২৪ |
নেপাল | ২০১৮ | ২২০-২৭৪ |
ইন্দোনেশিয়া | ২০১৬ | ৩৭১ |
এখানে বাঘেদের আবার দুটি উপপ্রজাতিতে ভাগ করা হয়েছে। একটি হলো প্যানথারা টিগ্রিস-টিগ্রিস এবং অপরদিকে অন্যটির নাম প্যানথারা টিগ্রিস সোনদাইকা। প্রথমটিতে ৬টি বাঘের মধ্যে ২টি বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং দ্বিতীয় উপপ্রজাতির ৩টির মধ্যে ২টিই বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
বেঙ্গল টাইগারঃ
ভারত উপমহাদেশে বেঙ্গল টাইগারের অস্তিত্ব প্রায় ১২,০০০- ১৬,০০০ বছর আগে থেকে পাওয়া যায়। তবে এদের প্রথম খোজ মিলে শ্রিলঙ্কায় প্রায় ২০,০০০ বছর আগে। এখন ভারতসহ আরোও তিনটি দেশে রয়েল বেঙ্গল টাইগার ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে ভারতে ২,৬০৩-৩,৩৪৬, বাংলাদেশে ৩০০-৫০০, নেপালে ২২০-২৭৪ এবং ভূটানে এদের সংখ্যা ৮৯-১২৪ টি। তবে খুশির সংবাদ ভারতে এদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
Image Source: wikipedia |
বেঙ্গল টাইগারের গায়ের পশম হলুদ থেকে হালকা কমলা হয়ে থাকে। এদের শরীরে ডোরা কাটা কালো দাগ থাকে। দূর থেকে এটি পশমের রং মনে হলেও এটি আসলে এদের চামড়ার রং। পুরুষ বাঘ মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত উচ্চতায় গড়ে ১১-১২ ফুট হয় এবং ওজনে ২০০-২৭০ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। অপরদিকে একটি মহিলা উচ্চতায় ৯-১০ ফুট এবং ওজনে ১৭০-২২০ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। তবে কিছু ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রমও হতে পারে। বাংলাদেশের সুন্দরবনে পাওয়া গেছে সবচেয়ে কম ওজনের বাঘীনি মাত্র ৭৫ কেজি। তবে অন্যান্য বাঘেদের মধ্যে এরা সবচেয়ে বড় এবং শক্তিশালী।
এই বাঘেরা জলে এবং স্থলে উভয় স্থানেই শিকারে পারদর্শী। এরা আচমকা শিকারের উপর ঝাপিয়ে পড়ে শিকারের শ্বাসনালী ধরে আকড়ে থাকে এবং নিজের শক্তিশালী দেহের বল দিয়ে ঘাড় মটকিয়ে দেয়, এবং শিকারের দেহ শিথীল না হওয়া পর্যন্ত ছাড়ে না। এরা একা শিকার করতে পছন্দ করে, এবং শুধুমাত্র মিলনের সময় তাদের একসাথে দেখা যায়। বাচ্চারা দুই বছর পর্যন্ত মায়ের সাথে থাকে। এদের খাদ্য সাধারণত বড় স্তন্যপায়ী প্রানী। যেমনঃ বুনো হরিণ, ষাড়, বাফালো। তবে এরা মাঝে মধ্যে ছোট প্রানী যেমনঃ শুকর, ময়ুর, সজারু, খরগোশও খায়। এরা বেশি ক্ষুধার্ত থাকলে হিংস্র ভাল্লুক, শিয়াল, কুমির, কিং কোবরা পর্যন্ত খেয়ে থাকে। এরা সচরাচর হাতি অথবা গন্ডারের উপর আক্রমন করে না। তবে স্রোতের বিপরীতে তারা প্রায় সময়ই যেতে পছন্দ করে। যার প্রমাণ ভারতে কিছু বাঘ মিলে ২০১১ সালে একটি ২০ বছরের হাতিকে শিকার করে এবং ২০১৪ সালে একটি ২৮ বছরের হাতিকে শিকার করে। ২০০৭ সালে বাঘেরা মিলে ২০টি গন্ডার মেরেছিলো।
সাইবেরিয়ান বাঘঃ
১০,০০০-১২,০০০ বছর আগে অবিভক্ত কোরিয়ায় এই সাইবেরিয়ান বাঘের আনাগোনা ছিল। তবে, এখন এই বাঘ রাশিয়ায় (৩৩১-৩৯৩) এবং চীনে (১৮-২৪)টি রয়েছে।
আমুর বাঘ নামেও পরিচিত এই বাঘটির গায়ের রং অনেকটা মরিচার মতো লালচে থেকে হলুদ-লালচে হয়ে থাকে। এদের গায়ে লম্বা ফিতের মতো কালো দাগ থাকে। এরা লম্বায় ৫ফুটের বেশি হয় না। ওজন ভেদে পুরুষ ১৭০-৩০৬ এবং নারী ১০০-১৬০ কেজি হয়ে থাকে। এরা তুষারে নিজেদের ভালোভাবে খাপখাইয়ে নিতে পারে।
Image Source: wikipedia |
এরা বড়-ছোট অনেক প্রানী এবং মাছ খেয়ে থাকে। এরা শিকারের জন্য ১,০০০ কি.মি. এর বেশি অঞ্চল পর্যন্ত ভ্রমন করে থাকে। এদের বড় শিকারের মধ্যে আছে বিভিন্ন জাতের হরিন যেমনঃ মানচুরিয়ান ওয়াপিটি, সাইবেরিয়ান মাস্ক হরিণ, লম্বা লেজের গোরাল, সাইবেরিয়ান রো হরিণ, সিকা হরিণ এবং ভাল্লুকের মধ্যে এশিয়ার কালো ভাল্লুক। ছোট শিকারের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির খরগোশ, শুকর এমনকি ছোট জাতীয় ইদুর এবং সেলমন মাছ। সকল বাঘেদের শিকারের কৌশল একরকম হয়ে থাকে।
দক্ষিণ চীনা বাঘঃ
এই দক্ষিণ চীনা বাঘের অস্তিত্ব কি বর্তমানে আছে কি নেই সেটা নিশ্চিত করা যায় নি। ১৯৫০ সালের একটি জরিপে ৪০০০-৫০০০ বাঘের সংখ্যা ঘোষনা করেছিলো দেশটি। তবে মাত্র ৩২ বছরে এর সংখ্যা নেমে দাড়ায় ২০০ এর নিচে। আগামি ৫ বছর পর ১৯৮৭ সালে এর সংখ্যা কমে দাড়ায় ১৪-১৫টি তে। ২০০১ সালে চীন সরকার অনুসন্ধান চালিয়ে এর কোনো অস্তিত্ব খুজে পায়নি। তবে ২০০৭ সালে বনে এক এশিয়ান কালো ভাল্লুকের ধংস্বাবশেষ খুজে পাওয়া যায়। যা থেকে অনুমান করা যায় যে এরা বিলুপ্ত হয়নি।
Image Source: wikipedia |
১৯০৫ সালে জার্মান প্রাণিবিদ ম্যাক্স হিলজহেইমারের বর্ণনায় এই বাঘের গঠন সম্পর্কে জানা যায়। তিনি বলেন যে এই বাঘগুলো উচ্চতায় ১০-১১ ফুটের হয়ে থাকে, যা একটি বেঙ্গল টাইগারের সমান। আর ওজনে ১০০-১১৫ কেজি হয়ে থাকে।
এরা তাদের আশেপাশে যেকোনো মাংসপেশীয় প্রানী খেয়ে থাকে। এরা শুকর থেকে শুরু করে হরিণ, খরগোশ, ময়ুর ইত্যাদি খেয়ে থাকে।
ইন্দো চীনা বাঘঃ
একসময় চীনে চড়ে বেড়ানো এই বাঘটি চীন এবং ভিয়েতনাম থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেলেও মিয়ানমার, থাইলেন্ড এবং লাওস দেশে দেখা যায়। বিলুপ্তির পথে থাকা এই বাঘটি থাইল্যান্ডে রয়েছে ১৮৯টি, মিয়ানমারে ৮৫টি এবং লাওসে মাত্র ১৪টি।
ইন্দো-চীনা বাঘেদের মাথার খুলি বেঙ্গল টাইগার থেকে ছোট হয়ে থাকে। তবে তারা উচ্চতায় গড় বেঙ্গল টাইগারের সমান। পুরুষদের ওজন ১৫০ থেকে ১৯৫ কেজি এবং নারীদের ওজন ১০০ থেকে ১৩৫ কেজি হয়ে থাকে।
Image Source: wikipedia |
এরা শিকার পুরো বিস্তির্ণ এলাকাজুরে করে থাকে। ১২-১৪টি বাঘের দল ২ থেকে ২৮৭ কি.মি. পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে এবং শিকার করে থাকে। এরা সামবার হরিণ, বানটেং, গুয়োর, বুনো শুকর, এশীয় হাতি এমনকি বানরও শিকার করে খায়।
সুমাত্রান বাঘঃ
সুন্দা দ্বীপের একমাত্র বাঘ যারা এখনও টিকে আছে। এদের অস্তিত্ব ১২,০০০-৬,০০০ বছর পূর্বে পাওয়া যায়। ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রান দ্বীপে এদের প্রথম পাওয়া যায় বলে স্থানের নামানুসারে এদের নামকরণ করা হয়। বর্তমানে এদের সংখ্যা ৩৭১টি। তবে কিছু সংরক্ষিত অঞ্চলে এদের জনসংখ্যা বাড়ছে।
বাংলা বাঘ বা বেঙ্গল টাইগার এবং জাভান বাঘ থেকে এরা মাথার খুলি এবং কাঠামো গঠন অনুযায়ী বেশ আলাদা। তাদেরকে সবচেয়ে ছোট বাঘ হিসেবে গন্য করা হয়। উচ্চতায় ৮-৯ ফুট এবং ওজনে পুরুষেরা ১০০-১৪০ কেজি এবং নারীরা ৭৫-১১০কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। এদের গায়ের পশমের রঙ বাংলা বাঘ থেকে অনেক গাড় হয়ে থাকে।
Image Source: wikipedia |
সুমাত্রান বাঘেরা এমন বনে থাকতে পছন্দ করে যেখানে মানুষেরা এখনো কোনো কিছু করেনি। কেননা এরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে পছন্দ করে। এরা একটু লাজুক ধরনের তাই মানুষের কাছে আসতে ভয় পায়। এদের শিকারের মধ্যে রয়েছে গ্রেট আরগুস, মালায়ান পরকিউপিন, মালায়ান তাপির, বানডেড শুকর, ইন্ডিয়ান মুনজাক, সামবার হরিণ।
মালায়ান বাঘঃ
মালেশিয়ার উপদ্বীপ মালয়ে এদের পাওয়া যায় বলে এদের নাম রাখা হয় মালায়ান বাঘ। ২০১৩ সালের প্রতিবেদনে এদের সংখ্যা ২৫০-৩৪০ এর মধ্যে আছে বলে জানায় দেশটির সরকার। এদের কিছু সংখ্যক বাঘ একসময় থাইল্যান্ড এবং সিঙ্গাপুরে ছিল। তবে ১৯৩২ সালে সিঙ্গাপুরের শেষ বাঘটিকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
Image Source: wikipedia |
এদের মধ্যে পুরুষদের উচ্চতা ৭-৮ ফুট এবং ওজন ৪৭-১৩০ কেজি, অপরদিকে নারীরা উচ্চতায় ৬-৭ ফুট এবং ওজন ২৪-৮৮ কেজির কাছাকাছি হয়ে থাকে। এদের গায়ের রঙ আর ইন্দো-চীনা বাঘেদের গায়ের রঙ একই।
মালায়ান বাঘেদের খাদ্য তালিকায় আছে সামবার হরিণ, বারকিং হরিণ, বুনো শুকর, বোরনিন বিয়ারডেড শুকর এবং সেরো। এদের পাশাপাশি এরা সূর্য ভাল্লুক, হাতির বাচ্চা, গন্ডারওশিকার করে থাকে।
পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া বাঘ
কাপ্সিয়ান বাঘঃ
মধ্যযুগ থেকেই এই কাপ্সিয়ান বাঘের অস্তিত্ব পৃথিবীতে ছিলো। এদের তুর্কি, ইরান, মেসোপটামিয়া, কাপ্সিয়ান সাগর, মধ্য এশিয়া থেকে আফগানিস্থান, চীনের জিনঝিয়াং রাজ্যে এবং বর্তমান উকারিন এবং রাশিয়ায় এদের খোজ মেলে। এদের ১৯৭০ পর্যন্ত এসব দেশে এবং অঞ্চলে চড়ে বেড়াতে দেখা যেত।
সাইবেরিয়ান বাঘের থেকে অনেকটা উজ্জল রঙের পশম এবং অনেকটা বাদামি রঙের চিকন সরু দাগ ছিল কাপ্সিয়ান বাঘেদের। পুরুষরা উচ্চতায় ৯-১০ ফুট এবং ওজন সাধারণত ২৭০-২৪০ কেজি হয় এবং নারীরা উচ্চতায় ৮-৯ ফুট এবং তাদের ওজন ৮৫-১৩৫ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে।
এদের খাদ্য ছিলো মূলত বুনো শুকর, লাল এবং রো হরিণ, ব্যাক্টিরান হরিণ।
জাভা বাঘঃ
১৯৭০ সালে এদের নিশ্চিহ্ন হওয়ার ঘটনা হয়ত তখন দেশের স্থানীয়দের কাছে অনেক আনন্দের ব্যাপার ছিল। ২০০৮ সালে আবার সুন্দা দ্বীপে এদের খোজ করা হয় এবং জানানো হয় যে জাভা বাঘ আর পৃথিবীতে একটিও নেই। মূলত শিকার এবং বন উজার করার কারণেই এদের বিলুপ্তি ঘটেছে।
এরা অনেকটা সুমাত্রান বাঘের আকৃতির ছিল। এদের কালো ডোরা কাটা দাগ এবং শুচালো নাক এদেরকে অন্যান্য বাঘ থেকে আলাদা করেছে। পুরুষেরা দৈহিক গঠনের দিক দিয়ে উচ্চতায় ছিল ১০ ফুটের আশেপাশে এবং ওজন ১০০-১৪১ কেজি ছিল। অন্যদিকে নারীরা ছিল ৮-৯ ফুট এবং ৭৫-১১৫ কেজির।
এদের শিকারের কবলে পড়তো জাভান রুষা, বানটেং, বুনো শুকর, এবং মাঝেমধ্যে কিছু জলচর পাখি এবং কিছু সরীসৃপ জাতীয় প্রানী।
বালি বাঘঃ
২০১৭ সালে শেষবারের মতো সুন্দা দ্বীপে খোজ চালানোর পর ঘোষণা এলো, ১১,০০০-১২,০০০ বছর পর্যন্ত টিকে থাকা এই বালি বাঘ আর নেই। যদিও এদের শেষ বার দেখা গিয়েছিলো ১৯৩০ এর শেষ দিকে, তবুও, অনেকেই বলেছেন এরা হয়তো ১৯৪০-১৯৫০ পর্যন্ত টিকে ছিলো।
Image Source: wikipedia |
জাদুঘরে সংরক্ষিত এদের চামড়া এবং মাথার খুলি পর্যালোচনা করে জার্মান প্রাণিবিদ পুরুষদের চামড়া মেপে এদের উচ্চতা ৮-৯ ছিল বলে জানান এবং এদের ওজন সম্ভবত ৯০-১০০ কেজি হতে পারে। একইভাবে নারীদের উচ্চতা ৭-৮ ফুট এবং ওজন ৬৫-৮০ কেজি হতে পারে বলে জানান।
তাদের খাদ্য তালিকা খুব সম্ভবত মেনগ্রোভে থাকা জীবজন্তু ছিল।
প্রাগৈতিহাসিক ফসিল
এখন পর্যন্ত পাওয়া পুরোনো বাঘের খুলি ও কঙ্কারকেই প্রাগৈতিহাসিক ফসিল বলে। এখন এমন কিছু হারিয়ে যাওয়া বাঘের কথা বলব।
গানডং বাঘঃ ইন্দোনেশিয়ার সুন্দাভূমিতে এদের হাড় খুজে পাওয়া যায়। এরা সাধারণত বর্তমান যুগের যে কোনো বাঘ থেকে আকারে বড় ছিল।
ট্রিনিল বাঘঃএদের ইন্দোনেশিয়ার জাভা আবিষ্কার করা হয়েছে। ধারণা করা হয় প্রায় ৫০,০০০ বছর আগে এরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। বর্তমানে এদের অঙ্গবিশেষগুলো নেদারল্যান্ডের জাতীয় জাদুঘরে রাখা হয়েছিল। এরা ইন্দোনেশিয়ায় প্রায় ১৬ লক্ষ বছর পর্যন্ত টিকে ছিল।
আকুটিডেন বাঘঃচীনের সিচুয়ান প্রদেশে এদের আমেরিকার কিছু ছাত্ররা এই বাঘের জীবাশ্ম খুজে পায়। বর্তমানে এর জীবাশ্মগুলো আমেরিকার প্রাকৃতিক সম্পদ জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।
লংড্যান বাঘঃ২০০৪ সালে গানসু প্রদেশের একটি ছোট্ট গ্রাম থেকে এদের জীবাশ্ম উদ্ধার করা হয়। এরা আজ থেকে প্রায় ২০-৩০ লক্ষ বছর আগে পৃথিবীতে চড়ে বেড়াতো।
বোরনিয়ান বাঘঃ বোরনিয়ান অঞ্চলে খুজে পাওয়া এই বাঘটি ৪-৬ লক্ষ বছর আগে পৃথিবীতে বসবাস করতো। এদের হাড় এশিয়া সহ পৃথিবীর কয়েক জায়গায় পাওয়া যায়।
হাইব্রিড বাঘ
বাঘ ও সিংহের মিলনের ফলে যে নতুন প্রজাতির সৃষ্টি হয় তাকে সংকর বা হাইব্রিড বাঘ বলে। লাইগার, পুরুষ সিংহ এবং স্ত্রী বাঘের সাথে মিলন হলে আমরা এদের পেয়ে থাকি। এরা মা-বাবা উভয় থেকে আকারে বড় হয়। লাইগার বাঘেদের মতো সাতার কাটতে পারদর্শী। অন্যদিকে টাইগন হলো পুরুষ বাঘ এবং স্ত্রী সিংহের মিলনের ফল। এরা আকারে মা ও বাবা উভয় থেকেই ছোট হয়। তবে এদেরকে অনেকেই বামন ভেবে ভুল করে যা অবশ্যই ঠিক না। টাইগন দুই প্রজাতির জিন বহন করে এবং এরা অন্যান্য বাঘ বা সিংহের থেকে আলাদা।
মিউটেন্ট বাঘ
সাদা বাঘ বা তুষার সাদা বাঘ এবং সোনালী বাঘ। এদের নাম শুনেছেন? যখন বিভিন্ন রঙের বাঘের মিলন ঘটানো হয় তখন এই তিন রঙের বাঘের সৃষ্টি হয়। যার মধ্যে সাদা বাঘ আমাদের বেঙ্গল টাইগারের মিউটেন্ট। তবে এখন অরণ্যে এদের দেখা যায় না। ১৯৫৮ সালে শেষ সাদা বাঘকে মেরে ফেলা হয়। তবে ভারতে ২০০টি সাদা বেঙ্গল টাইগার উৎপন্ন করা হয়েছে এই একই পদ্ধতিতে। তবে এরা অনেক দূর্বল প্রকৃতির হয় এবং বেশিদিন বাচে না। সোনালী বাঘও মূলত বেঙ্গল টাইগারই। এরা অরণ্যে না থাকলে ভারতে ৩০টি সোনালী বাঘের পর্যবেক্ষণ করছে। কালো বাঘও খুবই বিরল একটি বাঘ যা সচরাচর চোখে পড়ে না।
বাঘ কি মানুষ খেতে পছন্দ করে
সচরাচর না। হঠাৎ করে মানুষের অস্তিত্ব টের পেলে আত্মরক্ষার জন্য বা যদি শিকার করতে অক্ষম বয়স্ক বাঘ এমনকি কম বয়সে রক্তের স্বাদ পাওয়া বাঘেরা মূলত এইরকম অঘটন ঘটিয়ে থাকে। আর যখন বাঘ ক্ষুধার্ত থাকে তখন হয়ত এরা তাদের প্রতিবেশি বড় বিড়াল যেমনঃ চিতা, সিংহ, জেগওয়ারদেও ছাড়ে না।
কেন এরা বিলুপ্তির পথে
মানুষ তাদের নিত্যপ্রয়োজনের জন্য বাঘেদের বাসস্থান কেটে ফেলেছে। তাদেরকে হত্যা করেছে এমনকি নিজের খাদ্য হিসেবেও বক্ষন করেছে। এদের চামড়াকে নিজের বাসার সৌন্দর্য বানিয়েছে। বাঘ মারার প্রতিযোগিতাও করেছে। তাদের এই অবেহেলার কারনেই বাঘ এখন বিলুপ্তির পথে। বাঘের বাস্তুসংস্থান নির্মূল করে একরের পর একর শুধু এক ধরনের গাছ লাগিয়েছে। যাতে করে বাঘের শিকারের খাবার সংকট তৈরি হয়েছে এবং খাবারের অভাবে তারা আস্তে আস্তে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে এবং বাঘ কোনো উপায় না পেয়ে মানুষের উপর আক্রমন করেছে। এভাবেই বাঘে এবং মানুষে জীবন মরনের সংগ্রাম শুরু হয়েছে।
A hunting party poses with a killed Javan tiger, 1941 |
বাঘের সংরক্ষণে বিভিন্ন দেশের ব্যবস্থা
প্রতিটি দেশের সরকারই তাদের দেশের সম্পদ বাঘকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করছে। কেও এর সুফল পাচ্ছে কেও আশাবাদী যে সুফল আসবে খুব শীঘ্রই। ২০১০ সাল থেকে বিশ্বে বাংলাদেশ সহ মোট ১৩টি ২৯শে জুলাই বিশ্ব বাঘ দিবস পালন করে থাকে। ২০২২ সালে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুন করার উদ্যেশকে মাথায় রেখে এইদিনটিকে উৎযাপন করা হয়। ভারত, নেপাল ও ভূটানে বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে বাংলাদেশে বিভিন্ন বাধা বিপত্তির কারণে হয়ে উঠছে না। তবে বন বিভাগ এই বিষয়টি নিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে সাইবেরিয়ান বাঘেরও অনেক প্রসার ঘটেছে। চীন এখন বিশ্বে বাঘের দ্বিতীয় বৃহত্তম আস্তানা হয়ে দাড়িয়েছে। প্রায় ৪,০০০ সাইবেরিয়ান বাঘকে এরা একটি বিশাল অঞ্চলে ছেড়ে দিয়েছে। অবশ্যই এই অঞ্চলে কোনো জনমানব নেই। ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রান এবং মালায়ান বাঘও কিছু সংখ্যক হারে একটি ছোট অঞ্চলে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে কিছু সংখ্যক উত্তর আমেরিকা এবং নিউজিল্যান্ডের চিরিয়াখানায় আছে। একই সাথে অরণ্যে হারিয়ে যাওয়া ইন্দো-চীনা বাঘও চীনের চিরিয়াখানায় আছে। তবে এরা কেউই বনের মুখ দেখেনি।
ছোট করে বলার মতো কিছু নেই আশা করি আপনাদেরকে একটু করে বাঘেদের ব্যপারে বুঝাতে পেরেছি। বাঘ যে আমাদের অরণ্য থেকে হারিয়ে যাচ্ছে, এঠার কিন্তু বিশাল এক প্রভাব প্রকৃতির ওপর পড়ছে। পৃথিবরি বাস্তুতন্ত্র পরিবর্তন হচ্ছে। আজ যেখানে বাঘ থাকলে, সে যে জন্তুগুলোকে খেত তাদের সংখ্যা যেরকম থাকার কথা ছিল, তা কিন্তু অনেক হারে বেড়ে গিয়েছে। আপনি ভাবছেন এটাতো ভালো কথা! মোটেই না। বেশি জনসংখ্যা মানে বেশি খাদ্যের চাহিদা এবং আমরা যে হারে বন উজার করছি ওদের খাদ্যের অভাবটা কোন পর্যায়ে পৌছেছে ভেবে দেখেছেন? চলুন আমরা সর্তক হই!
আমাদের প্রতিবেদনটি ভালো লাগলে লাইক ও শেয়ার করুন এবং অন্যদের জানার সুযোগ করে দিন । এছারাও কমেন্টের মাধ্যমে আপনার সুযোগ্য মতামত জানতে ভুলবেন না ।
লেখকঃ নূরই জাবাল হক ইমন
আমাদের ফেইসবুক পেইজ- প্রিয়জানালা