bangla moviemovies

হোলি আর্টিজানের ঘটনা থেকে শনিবার বিকেল ও ফারাজ?

এক সুন্দর শনিবারের বিকেলে ঢাকা শহরের লোকজন তাদের সময় উপভোগ করছে, হঠাৎ করে একদল সন্ত্রাসী শহরের একটি রেস্তোরাঁ দখল করে নেয় এবং কর্মচারী ও ক্রেতাদের জিম্মি করে । পুলিশ দ্রুত ভবনটি ঘিরে ফেলে এবং সন্ত্রাসীদের আত্মসমর্পণ করতে বলে । রেস্তোরাঁয় থাকা বিদেশী, প্রতিবন্ধী, নারী, ব্যবসায়ী, শিল্পী এমনকি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মুসলমানরাও সন্ত্রাসীদের নিষ্ঠুর বৈরিতার শিকার হয় । এইদিকে জিম্মিদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা না করে, আরও বেশি দর্শককে আকৃষ্ট করার জন্য কিছু সংবাদ গণমাধ্যম এই ঘটনাটির সরাসরি সম্প্রচার শুরু করে । অন্যদিকে রেস্তোরাঁয় সন্ত্রাসীরা এক এক করে জিম্মিদের হত্যা করতে শুরু করে ।

২০১৬ সালে গুলশানের হলি আর্টিজানে এই জঙ্গি হামলা হয়, সেই ঘটনার ছায়া অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘শনিবার বিকেল’ সিনেমাটি । এটি বাংলাদেশ, ভারত ও জার্মানির যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত করা হয় । মুভিটির মুক্তির আগে বিভিন্ন বিতর্কের মুখোমুখি হতে হয়েছে, প্রায় চার বছর সেন্সর বোর্ডে আটকে আছে মুভিটি ।

জঙ্গি হামলার একই ঘটনা নিয়ে বলিউডে নির্মিত হয়েছে ‘ফারাজ’ নামের একটি ছবি, এটি নির্মাণ করেছেন হংসল মেহতা । ইতিমধ্যে মুক্তি পেয়েছে ‘ফারাজ’ সিনেমার ট্রেলার । টি-সিরিজের ব্যানারে সিনেমাটি বাংলাদেশের ঘটনা নিয়ে নির্মিত হলেও সিনেমাটির সংলাপ হিন্দি, পুরো ট্রেলারে বাংলা সংলাপ ছিল না । ছবিটি ৩ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পেতে যাচ্ছে ।

হোলি আর্টিজানের ঘটনা থেকে শনিবার বিকেল ও ফারাজ?
মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ও তিশা

একই ঘটনা নিয়ে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বছর চারেক আগে ‘শনিবার বিকেল’ সিনেমা নির্মাণ করলেও নানানরকম নিষেধাজ্ঞার কারণে দেশের সিনেপর্দায় ছবিটি মুক্তি দেয়া হয়নি । সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী লিখেছেন “আমরা আশা করি উনারা দ্রুতই আমাদের এই বিষয়ে চিঠি দিবেন, যাতে আগামী শুক্রবার বা তার পরের শুক্রবার ছবিটা মুক্তি পায় । মোট কথা ফারাজের সাথে বা আগেই ছবিটা মুক্তির ব্যবস্থা করবো ইনশাল্লাহ” ।

তবে এরই মধ্যে ‘ফারাজ’ এবং “শনিবার বিকেল” নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে নতুন বিতর্ক । ১৯ জানুয়ারি সকালে রাজধানীতে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয় সিনেমাটি কেন্দ্র করে । হোলি আর্টিজানের ঘটনায় নিহত অবিন্তা কবিরের মা রুবা আহমেদ এই সম্মেলনের আয়োজন করেন । সেখানে তিনি সিনেমাটির মুক্তি নিয়ে তীব্র প্রতিবাদ জানান । তার দাবি, যেহেতু সিনেমাটি বাস্তব ঘটনায় নির্মিত, মুক্তির আগে ওই ঘটনায় নিহতদের সদস্যদের পরিবারের অনুমতি নেওয়া উচিত ছিল, এই সিনেমা মুক্তির পর নিহতরা হয়তো নেতিবাচকভাবে সবার সামনে উপস্থাপিত হবেন । সিনেমাটির মুক্তি যেন বন্ধ করা হয়, সেজন্য তিনি কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন । তিনি বলেন, “কেনো দেশের সিনেমা  “শনিবার বিকেল” মুক্তি না দিয়ে, ভিনদেশীদের নির্মাণ করা “ফারাজ” সিনেমা মুক্তি দেয়া হচ্ছে !! ফারাজ হিরো এটা তারা কিভাবে জানলো !! একজনকে হিরো বানানোর জন্য বাকি চরিত্র গুলো কে ব্যবহার করা হয়েছে, এখানে ২২ জনই হিরো এবং ছবি তৈরীর আগের প্রত্যেকের পরিবার থেকে অনুমতি নেয়া উচিত ছিল” ।

হোলি আর্টিজানের ঘটনা থেকে শনিবার বিকেল ও ফারাজ?
শনিবার বিকেল

তিনি আরো বলেন, আমি আমার মেয়েকে ২০১৬ সালে হারিয়েছি । আমার কাছে মনে হয়েছে, এখানে ২২টি পরিবারের কেউ না কেউ গেছে । যে দেশে ছবিটি মুক্তি দেয়া হচ্ছে, সেদেশে ঘটনাটি ঘটেনি । ঘটেছে আমাদের এই বাংলাদেশে । অবিন্তার মা আরও বলেন, ২০১৯ সালের শেষের দিকে আমি জানতে পারি হলি আর্টিজানের ঘটনা নিয়ে একটি সিনেমা হচ্ছে । তখন থেকে চেষ্টা করেছি বিভিন্নভাবে উকিল নোটিশ দিয়ে সিনেমাটির কার্যক্রম থামানোর জন্য । ২০২০ সালে যখন করোনা শুরু হলো সে সময় পুরো দুনিয়া অন্যরকম হয়ে গিয়েছিল । আমার ধারণা ছিল, সেই সিনেমাটির নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়ে গেছে । নিজেকে নিজেই বুঝানোর চেষ্টা করেছি, ভালোই হলো । করোনার কারণে সিনেমার কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে । তারপর ২০২১ সালে এই সিনেমার পোস্টার পাই । তখন বুঝেছি নির্মাণ কাজ আসলে বন্ধ হয়নি । তখন থেকে আজকের দিন পর্যন্ত মুভিটি বন্ধ করার জন্য দিল্লি হাইকোর্টে মুভ করেছি । এখনও আমার মামলার কার্যক্রম চলছে । যারা সিনেমাটি বানিয়েছেন তারা ভারতের নামিদামি প্রযোজক, পরিচালক । তাদের সঙ্গে আমি ফাইট করে যাচ্ছি । অবিন্তার মা বলেন, সিনেমাটির নাম ফারাজ হয়েছে । তার মানে একটি ক্যারেক্টারের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে । সেই ক্যারেক্টারকে জোর দিতে গিয়ে আমার মেয়ের কথা চলে এসেছে । আমরা জানি না সেদিন আমার সন্তান এবং অন্যরা কিসের মধ্য দিয়ে গিয়েছিল । কেউ আমরা জানি না । কোনদিন আমরা জানতেও পারবো না । সে কারণে আমরা একটি গল্প বানালাম সেই গল্প বানিয়ে মুভিটা তৈরি করলাম । কিন্তু এই মুভির সঙ্গে যে পরিবারগুলো আছে তাদের কাছ থেকে তো কনসেন্ট নিতে হবে । আমাদের কাছ থেকে তো কোন কনসেন্ট নেওয়া হলো না? আমি কোর্টে যাওয়ার পর বলেছিলাম, আমাকে প্রি-স্ক্রিনিংয়ের সুযোগ দেওয়ার জন্য, কিন্তু পরে আর দেওয়া হয়নি । আমার মেয়ের নাম ব্যবহার করা হয়েছে কিনা জানতে চাওয়া হলে তখন বললো, করা হয়নি । সবই যদি ব্যবহার করা না হয়ে থাকে তাহলে মুভিটার মধ্যে কী আছে” ?

হোলি আর্টিজানের ঘটনা থেকে শনিবার বিকেল ও ফারাজ?

২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ছবিটি হলি আর্টিজানের ঘটনা অবলম্বনে কিনা সে সম্পর্কে বলেন, “এটা হোলি আর্টিজান ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত, কিন্তু সেই ঘটনার হুবহু পুননির্মাণ না । চরিত্রেরাও আলাদা । মাত্র সাত দিনে ছবিটির শুটিং শেষ হয় । বাংলা ছাড়াও ইংরেজি ভাষায় ছবিটি ডাবিং করা হয় । এ চলচ্চিত্রটি নির্মাণের পর বাংলাদেশে মুক্তি পাবে কিনা তা নিয়ে ধুম্রজাল তৈরী হয় । বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড চলচ্চিত্রটিকে প্রাথমিকভাবে সবুজ সংকেত দেয় । তবে দ্বিতীয় দফায় পর্যবেক্ষণের পর ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে এই অভিযোগে এর ছাড়পত্র স্থগিত করা হয় । সেন্সর বোর্ডের একজন সদস্য জানান চলচ্চিত্রটি একপ্রকার নিষিদ্ধ করা হয়েছে । তবে সম্পুর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হবে কিনা, এই সিদ্ধান্ত পরবর্তীতে নেওয়া হবে বলে জানান । দ্বিতীয় দফায় নিষিদ্ধকরণের পক্ষে তথ্যসচিব এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মত প্রদান করে । সেন্সর বোর্ডের মতে “ভুলে যাওয়া বিয়োগান্তক ঘটনা নতুন করে মনে করিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না । ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ফারুকীর নেতৃত্বে একদল শিল্পী এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে নানাভাবে প্রতিবাদ জানায় । ২০২২ সালের আগস্টে, বাংলাদেশের নেটিজেনরা এই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে অনলাইনে প্রতিবাদ জানায় ।

হোলি আর্টিজানের ঘটনা থেকে শনিবার বিকেল ও ফারাজ?

হলি আর্টিজানে ফারাজ কি আসলেই তার বন্ধুদের বাঁচাতে গিয়ে মারা গেছে সেই ধোয়াশা অনেকেরই পরিষ্কার না, যেহেতু যে ২২ জন মারা গেছে তাদের কিছুই সাধারণ মানুষ জানেনা । এটি নিয়েই সেদিনের ঘটনার শিকার ফারাজের বন্ধ অবন্তী কবিরের মা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মিডিয়ায় ।

সব বিতর্কের পর দীর্ঘ ৪ বছর সেন্সর বোর্ডে আটকে থাকার পর ২০২৩ সালের ২১ জানুয়ারি সিনেমাটিকে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের আপিল কমিটি মুক্তির ছাড়পত্র দেয় । এতদিনের অপেক্ষার পর এবার আলোর মুখ দেখলো “শনিবার বিকেল” সিনেমাটি । ইতিমধ্যে জানা গেছে খুব দ্রুত মুভিটিকে মুক্তি দেয়া হবে ।

Back to top button