সালমান শাহ – ২৫ বছর পরেও বাংলাদেশের জনপ্রিয় নায়ক
সালমান শাহ মাত্র ৪ বছরে করেন ২৭টি হিট সিনেমা!
সালমান শাহ ছিলেন একজন বাংলাদেশী অভিনেতা ও মডেল । তার প্রকৃত নাম শাহরিয়ার চৌধুরী ইমন । টেলিভিশন নাটক দিয়ে তার অভিনয় জীবন শুরু হলেও ৯০ দশকে তিনি চলচ্চিত্রে অন্যতম জননন্দিত শিল্পী হয়ে উঠেন । জনপ্রিয় এই নায়ক নব্বই দশকের বাংলাদেশে সাড়া জাগানো অনেক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন । তিনি সর্বমোট ২৭টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন এবং সবকয়টিই ছিল ব্যবসাসফল । একদিন অকালে রহস্যজনক ভাবে মৃত্যুবরণ করেন তিনি । চলুন জেনে নেওয়া যাক , বাংলাদেশের প্রিয় নায়ক সালমান শাহর শুরু থেকে শেষ ।
সালমান শাহর জন্ম ১৯৭১ সালে ১৯ সেপ্টেম্বর , বাংলাদেশের সিলেট শহরে দাড়িয়া পাড়াস্থ তার নানার বাড়িতে , যা এখন সালমান শাহ ভবন হিসেবে পরিচিত । তার পিতা কমর উদ্দিন চৌধুরী ও মাতা নীলা চৌধুরী । তিনি পরিবারের বড় ছেলে । যদিও তার জন্মনাম শাহরিয়ার চৌধুরী ইমন , কিন্তু চলচ্চিত্র জীবনে তিনি সবার কাছে সালমান শাহ বলেই পরিচিত ছিলেন । সালমান পড়াশুনা করেন খুলনার বয়রা মডেল হাইস্কুলে । একই স্কুলে চিত্রনায়িকা মৌসুমী তার সহপাঠী ছিলেন । ১৯৮৭ সালে তিনি ঢাকার ধানমন্ডি আরব মিশন স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন । পরে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট ও ধানমন্ডির মালেকা সায়েন্স কলেজ থেকে বি.কম পাস করেন । সালমান শাহ ১২ আগস্ট ১৯৯২ তার খালার বান্ধবীর মেয়ে সামিরা হককে বিয়ে করেন । সামিরা হক ছিলেন একজন বিউটি পার্লার ব্যবসায়ী । তিনি সালমানের ২টি চলচ্চিত্রে তার পোশাক পরিকল্পনাকারী হিসেবে কাজ করেন । গায়ক হিসেবেও সালমানের পরিচিতি ছিল । ছোটবেলা থেকেই শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি দারুণ আগ্রহ ছিল তার । বন্ধুমহলে সবাই তাকে কণ্ঠশিল্পী হিসেবে চিনতেন । ছায়ানট থেকে পল্লীগীতিতে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন তিনি । জনপ্রিয় এই নায়কের জন্মদিনে বিভিন্ন সংগঠন , সংবাদপত্র ও টেলিভিশন নানা আয়োজন করে থাকে ।
১৯৮৫ সালে বিটিভির আকাশ ছোঁয়া নাটক দিয়ে অভিনয়ের যাত্রা শুরু করেন । তারপর আরো বিভিন্ন নাটকে তাকে দেখা যায় । নয়ন ( ১৯৯৫ ) নাটকটি সে বছর শ্রেষ্ঠ একক নাটক হিসেবে বাচসাস পুরস্কার লাভ করে । প্রথম সিনেমা দিয়েই মাত্র ২২ বছর বয়সে তারকা হয়ে যান সালমান শাহ । ১৯৯৩ সালে মুক্তি পায় সালমানের প্রথম ছবি কেয়ামত থেকে কেয়ামত । ফেসবুক ছিল না , ইউটিউব ছিল না , ছিল না প্রচারণার এত শত মাধ্যম । তারপরও ছবি মুক্তির প্রথম সপ্তাহেই নবাগত সালমান শাহ ও মৌসুমী হয়ে ওঠেন তারকা । নিজের ব্যক্তিত্ব , নায়কোচিত চাহনি আর অভিনয় দিয়ে শুরুতেই সালমান বুঝিয়ে দেন , তিনি এই সিনেমার জগতে এসেছেন রাজত্ব করতে । কেয়ামত থেকে কেয়ামত ছবির পরিচালক সোহানুর রহমান সোহান শুরু থেকেই দেখেছেন জনপ্রিয় এই চিত্রনায়কের উত্থান । সম্প্রতি সালমান শাহকে নিয়ে তিনি বলেন , সালমান এলো , জয় করলো , আবার চলে গেলো । তার এই ৪ বছরের ফিল্ম ক্যারিয়ার থেকে সে অনেক কিছু পেয়েছিল । কারও জীবনে এত অল্প সময়ে এত কিছু পাওয়া হয়না , যতটা সে পেয়েছিল ।
কেয়ামত থেকে কেয়ামত এই ছবি দিয়ে সালমান শাহ , মৌসুমী ও সংগীতশিল্পী আগুনের একসঙ্গে ঢাকাই সিনেমায় অভিষেক হয় । এরপর মৌসুমীর সঙ্গে সালমান শাহ অভিনয় করেন ” দেনমোহর ” চলচ্চিত্রে । এই সিনেমাটি মুক্তি পায় ১৯৯৫ সালে ।
এ ছাড়াও সালমান-মৌসুমী একসাথে অভিনয় করেন ” অন্তরে অন্তরে ” ও ” স্নেহ ” নামের আরও দু’টি সিনেমায় । এতো ছবিতে তারা কাজ করলেও জুটি হিসেবে সালমান অমর হয়ে আছেন শাবনূরের সঙ্গে । ” তুমি আমার ” ছবি দিয়ে শুরু হয় ঢাকাই সিনেমাতে দুর্দান্ত জনপ্রিয় জুটি সালমান-শাবনূরের পথচলা । চলচ্চিত্রে সবচেয়ে সফল জুটি সালমান শাহ-শাবনূর । প্রয়াত নির্মাতা জহিরুল হক ১৯৯৪ সালে নির্মাণ করেন ” তুমি আমার ” । এই সিনেমার মাধ্যমে প্রথম একসঙ্গে অভিনয় করেন সালমান-শাবনূর । এটি সালমানের দ্বিতীয় চলচ্চিত্র হলেও নায়িকা হিসেবে শাবনূর তখন বেশ কয়েকটি সিনেমায় অভিনয় করেছেন । তবে সালমানের সঙ্গে জুটি গড়ার পরেই শাবনূরের ক্যারিয়ারে সুবাতাস বইতে থাকে । এরপর একে একে ” সুজন সাথী ” , ” বিক্ষোভ ” , ” স্বপ্নের ঠিকানা ” , ” মহামিলন ” , ” বিচার হবে ” , ” তোমাকে চাই ” , ” স্বপ্নের পৃথিবী ” , ” জীবন সংসার ” , ” চাওয়া থেকে পাওয়া ” , ” প্রেম পিয়াসী ” , ” স্বপ্নের নায়ক ” , ” আনন্দ অশ্রু ” , ” বুকের ভিতর আগুন ”
মোট ১৩টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন সালমান-শাবনূর জুটি । সবগুলো ছবিই ছিলো সুপারহিট । নির্মাতারাও আগ্রহী হয়ে উঠেন এই জুটিকে নিয়ে । আরও বেশ কিছু ছবিতে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন তারা । তারমধ্যে অন্যতম ” নয়নমনি ” , ” তুমি শুধু তুমি ” , ” মন মানে না ” , ” কুলি ” , ” অধিকার চাই ” , ” মধু মিলন ” , ” কে অপরাধী ” , ” শেষ ঠিকানা ” ইত্যাদি । সালমানের মৃত্যুর পর রিয়াজ , ওমর সানী , অমিত হাসানকে দেখা গিয়েছিলো ছবিগুলোতে । ১৯৯৫ সালে মুক্তি পাওয়া ” স্বপ্নের ঠিকানা ” ছবিতে শাবনূরের সঙ্গে সালমানের আরেক নায়িকা ছিলেন সোনিয়া । সেই ছবিটি ১৯ কোটি টাকা ব্যবসা করে এখন পর্যন্ত সর্বাধিক আয় করা চলচ্চিত্রের তালিকায় দ্বিতীয় হয়ে আছে । পাশাপাশি ১৯৯৪ সালের শেষের দিকে জীবন রহমান পরিচালিত ” প্রেম যুদ্ধ ” চলচ্চিত্রে জুটি বাঁধেন সালমান-লিমা । পরের বছর দেলোয়ার জাহান ঝন্টুর ” কন্যাদান ” চলচ্চিত্রেও দেখা যায় এই জুটিকে । কিন্তু এই জুটি খুব একটা জনপ্রিয়তা পায়নি । ১৯৯৫ সালে হাফিজউদ্দিন পরিচালিত ” আঞ্জুমান ” চলচ্চিত্রে জুটি বাঁধেন সালমান-শাবনাজ । এই সিনেমাটির পর ” আশা ভালোবাসা ” ও ” মায়ের অধিকার ” সিনেমাতেও সালমান-শাবনাজ জুটিকে দেখা যায় । শাবনাজের সঙ্গে সফল জুটি ছিলেন সালমান শাহ । এছাড়াও সালমান শাহের সঙ্গে অভিনয় করেছেন বেশ কয়েকজন নায়িকা । এর মধ্যে রয়েছেন বৃষ্টি , শিল্পী , কাঞ্চি , শ্যামা , সাবরিনা , শাহনাজ ।
১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সালমান শাহর মৃত্যু হয় । জনপ্রিয় এই নায়কের আত্মহত্যা করেছিলেন নাকি তাঁকে খুন করা হয়েছিলো সেটি ২৫ বছরেও পুরোপুরি মীমাংসা হয়নি । তাঁর অস্বাভাবিক মৃত্যুর পর , থানা-পুলিশ , গোয়েন্দা পুলিশ , সিআইডি , র্যাব একে একে মামলাটির তদন্ত করে । সব তদন্ত প্রতিবেদনেই এটিকে আত্মহত্যা বলে উল্লেখ করা হয়েছে । স্ত্রী সামিরা হক পুলিশকে জানান , সকালবেলা ড্রেসিংরুমে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় সালমানের দেহ তাঁরা শনাক্ত করে দেহটি নামিয়ে আনেন । সালমান শাহকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন । সালমানের বাসা থেকে পুলিশ একটি সুইসাইড নোট উদ্ধার করে । চিঠিতে লেখা আছে , ” আমি সালমান শাহ এই মর্মে অঙ্গীকার করছি যে আজ অথবা আজকের পরে যেকোনো দিন মৃত্যু হলে তার জন্য কেউ দায়ী থাকবে না । স্বেচ্ছায় , সজ্ঞানে , সুস্থ মস্তিষ্কে আমি আত্মহত্যা করছি ” । এই চিঠিতে কারও স্বাক্ষর ছিল না । তবে সিআইডির হস্তবিশারদেরা পরীক্ষা করে বলেছেন , এটা সালমান শাহের হাতের লেখা ।
মৃত্যু ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর । মাত্র ২৫ বছরের জীবন । অথচ এখনও কী বিস্তৃত প্রভাব তার । মৃত্যুর এতবছর পরেও তার তারকাখ্যাতি সমুজ্জ্বল । সালমান শাহ-পরবর্তী সময়ে যারা চলচ্চিত্রে নায়ক হওয়ার জন্য এসেছেন তারা প্রত্যেকেই বলেছেন ” এখনও সালমান শাহ’ই ছিলেন তাদের অনুপ্রেরণার প্রধান উৎস ” । বলছিলাম সেই ২৪ বছর আগের কথা । কিন্তু বর্তমানে ফিরে এলেও সালমান শাহর ভক্তরা এখনো এই নায়ককে ভালোবাসেন আগের মতোই । সালমানের মৃত্যু রহস্যের তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশের পর সবার প্রতিক্রিয়া দেখে সেই ভালোবাসা আঁচ করা যায় । এই ভালোবাসার উষ্ণতা আরও বোঝা যায় যখন সেপ্টেম্বর আসে , অর্থাৎ সালমানের জন্ম ও মৃত্যুদিবসের মাস । প্রতিবছর ঢুলি কমিউনিকেশনস সেপ্টেম্বর মাসে আয়োজন করে সালমান শাহ জন্মোৎসব । সেই উৎসবে প্রদর্শিত হয় সালমান শাহ অভিনীত ছবিগুলো । এসব দেখতেই দর্শক যে পরিমাণে হলমুখী হন , তাতেই বোঝা যায় আড়াই দশক আগে হারিয়ে যাওয়া এই নায়ক এখনো কতটা প্রাসঙ্গিক । এছাড়া ফেসবুক , টুইটারে এখনো সালমানের নামে তৈরি পেজ ও গ্রুপগুলোর সক্রিয়তাও অনেককে অবাক করে দেয় । এখনো অনেকে নিজেকে ” সালমান শাহর ভক্ত ” হিসেবে পরিচয় দিতে গিয়ে আবেগী হয়ে পড়েন । এখনো বোঝা যায় , সালমান শাহ আছেন ও থাকবেন ।
আমাদের প্রতিবেদনটি ভালো লাগলে লাইক ও শেয়ার করুন এবং অন্যদের জানার সুযোগ করে দিন । এছারাও কমেন্টের মাধ্যমে আপনার সুযোগ্য মতামত জানতে ভুলবেন না ।
আমাদের ফেইসবুক পেইজ- প্রিয়জানালা