শ্রীলঙ্কা-দেউলিয়া ঘোষিত একটি দেশের গল্প
শ্রীলঙ্কা-দেউলিয়া ঘোষিত একটি দেশের কাহিনি!
SriLanka Economic Crisis
শিরোনাম দেখে চমকে উঠেছেন কি? দেউলিয়া ঘোষিত অনেক ব্যক্তির কথা শুনেছেন, কিন্তু দেউলিয়া রাষ্ট্রের কথা বোধহয় এই প্রথম শুনলেন। কিন্তু কিভাবে এমনটা হল? মূলত অপরিকল্পিত ঋণগ্রহন, রাজস্ব আসে না এমন খাতে বিনিয়োগ, করের হার কমিয়ে দেওয়ার মত ভিত্তিহীন সিদ্ধান্তের কারণেই শ্রীলঙ্কার আজকের এই পরিণতি। দেশটির বর্তমান প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষে গোতাবায়া সম্প্রতি দেশটির দেউলিয়া অবস্থা স্বীকার করে নিয়েছেন। এ মাসের শুরুর দিকে দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নেমে আসে ১০০ কোটি মার্কিন ডলারে যা দিয়ে মাত্র একমাসের আমদানি বাণিজ্য চালানো সম্ভব হত। দেশটির সরকারের হাতে এই মূহুর্তে নেই কোন রিজার্ভ, দেশটির ডিজেল, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য, বিদ্যুৎ খরচ না থাকায় দেশের মানুষ অর্ধেকের বেশী সময় অন্ধকারে থাকতে হচ্ছে। বাড়িতেই অফিস করছেন বেশীরভাগ মানুষ, মিল-কারখানা বন্ধ, ছাত্র-ছাত্রীদের পরীক্ষাও বন্ধ। মোটকথা দেশটি প্রায় স্থবির অবস্থায় দিনাতিপাত করছে। এজন্য চীনের পিপলস ব্যাংক অফ চীনের সাথে চুক্তির পর রিজার্ভ বেড়ে ১৫০ কোটি বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়, কিন্তু এই অর্থও ঋণের কিস্তি পরিশোধে যথেষ্ট ছিল না। ২০০০ সালের শুরু থেকেই শ্রীলঙ্কার অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য চীন এবং অন্যান্য দেশ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে আসছিল শ্রীলঙ্কা। কিন্তু এই ঋণ কোন উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ না করায় তা শুধু ঋণের বোঝাই বাড়িয়ে তুলেছে, হয়নি কোন জাতীয় আয়ের সুযোগ সৃষ্টি। শ্রীলঙ্কার স্বাধীনতার পর বিগত কোন সরকারই লাভজনকখাতে বিনিয়োগ বা ঋণের অর্থের সঠিক ব্যবহারে আগ্রহী ছিল না। বরং ২০১৯ সালে রাজস্ব হার আরো কমিয়ে দেওয়ার দেশটির জাতীয় আয় তলানীতে এসে ঠেকে। বর্তমানে দেশটির নিত্যব্যবহার্য পণ্যের দাম আকাশছোঁয়া। অফিস, আদালত বন্ধ, বাড়িতে বসেই অফিস করছেন অনেকে। শিক্ষাব্যবস্থার বেহাল অবস্থা। চড়ামূল্যেও নিত্যপণ্য পাওয়া যাচ্ছেনা, এমন অবস্থা পার করছেন লাখ লাখ শ্রীলঙ্কাবাসী। তবে এই সংকট উত্তরণের পথ খুঁজতে আইএমএফ, ভারতসহ বেশকিছু দেশ শ্রীলঙ্কার সাথে বৈঠকে বসার আগ্রহ দেখিয়েছেন। দেউলিয়া অবস্থা থেকে পুনরায় অর্থনীতির চাকা ঘুরাতে অবশ্যই সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে দেশটির সরকারকে।
শ্রীলঙ্কা চা সহ অন্যান্য কৃষিপণ্য উৎপাদন করে থাকে। এসব ক্ষেত্রেও প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করেছে শ্রীলঙ্কা। হাম্বানটোটা বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর, মেগাসিটি প্রকল্পে ব্যয় করা হয়েছে বিলিয়ন কোটি ডলার। এই ব্যয় মেটাতে তারা কিছুদেশে কৃষিপণ্য সরবরাহ করত, কিছু চড়াসুদে ঋণ নেওয়া হয়েছে, আবার কিছু ঋণ নেওয়া হয়েছে সার্বভৌম বন্ড ইস্যু করে। যেসব দেশের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশী তারা সার্বভৌম বন্ড আন্তর্জাতিক বাজারে ইস্যু করে ঋণ নিয়ে থাকে। শ্রীলঙ্কাও এভাবেই তহবিল সংগ্রহ করেছে কিন্তু এই অর্থ কিভাবে পরিশোধ করা হবে তা নিয়ে চিন্তা করেনি। সবচেয়ে বেশী ঋণ নিয়েছে দেশটি চীনের কাছ থেকে, কারণ চীন থেকে ঋণ নেওয়া সহজ। দেশটির ঋণের ১০% চীনের কাছ থেকে চড়াসুদে সংগ্রহ করা হয়েছে। ৪৭% সংগ্রহ করা হয়েছে বাণিজ্যকভাবে, বিশেষত সার্বভৌম বন্ড ইস্যু করে। বর্তমানে শ্রীলঙ্কা সাড়ে বারো বিলিয়ন ডলারের ঋনের ভারে জর্জরিত। এই ঋনের দায় মেটাতে আরও ঋন এবং অর্থসহায়তা নেওয়ার পরিকল্পনা করছে শ্রীলঙ্কা। এ ব্যাপারে শ্রীলঙ্কাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছে বিভিন্ন দেশ, বিশেষ করে ভারত। এছাড়াও আইএমএফ, জাতিসংঘ, এবং অন্যান্য সংস্থা ও দেশগুলোও কার্যকরভাবে সহযোগিতা করবে শ্রীলঙ্কাকে।
তবে এবার ঋন নিলে তা উৎপাদনশীলখাতে যেন ব্যবহার করা হয় সে ব্যাপারে অবশ্যই নজরদারি করা হবে। কারণ শ্রীলঙ্কার আজকের এই দূর্দশার কারণ হচ্ছে বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়ন করতে অর্থব্যয় যা কোন রাজস্ব আয়ে সহযোগিতা করে না। সবগুলো প্রকল্পের কাজ এখনও শেষ হয়নি। তবে ঋন নিয়ে প্রকল্পের কাজ আর নয়, উৎপাদনশীল কাজে বিনিয়োগ করে রাজস্ব এবং রপ্তানী বৃদ্ধি করে যাতে ঋন পরিশোধ করা যায় এবং আমদানি বাণিজ্য চালানো যায় এটাই হবে এবারের ঋন গ্রহনের উদ্দেশ্য। শ্রীলঙ্কার জনগণ বর্তমানে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের চরম অভাবে আছে, ডিজেল, বিদ্যুৎ, কাগজ, পানি, নিত্যপণ্য কোন কিছুই আমদানির অর্থ নেই সরকারের। এই সমস্যা উত্তরণে খুব শ্রীঘ্রই কার্যকর ব্যবস্থা নেবে দেশটির সরকার এটাই প্রত্যাশা।