bangla blogrecipe

বাঙালি রন্ধনশৈলীর ইতিহাস ও বর্তমান History of Bengali Cuisine

বাঙালি রন্ধনশৈলী

বাঙালি রন্ধনশৈলী হচ্ছে রান্নার একটা শৈলী যা ভারতীয় উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চলে বঙ্গে উৎপত্তি লাভ করে । প্রাচীন বঙ্গ অঞ্চল বর্তমানে বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ , ত্রিপুরা এবং আসামের বরাক ভ্যালীতে বিভক্ত হয়ে পড়েছে । এই অঞ্চলে প্রধান খাবার ভাত এবং মাছের সাথে মাংস , সবজি , ডাল দিয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে এর খাদ্য সম্ভার ।

বাঙালি রন্ধনশৈলীর ইতিহাস ও বর্তমান Bengali Cuisine
History of Bengali Cuisine

প্রাচীন বাংলার রান্না সম্পাদনা :


প্রাচীন বাংলার আহারের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল ভাত , মাছ , দুধ এবং সবজি । বঙ্গ অঞ্চলটি প্রাচীন হিন্দু ও বৌদ্ধ রাজত্বের সময় দক্ষিণ এশিয়ার একটি প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক অঞ্চল ছিল এবং পরবর্তীতে মুসলিম শাসন আমলেও । বাঙালি খাবারের বিভিন্নতা এবং বিচিত্র্তা ব্যাপক ও বিশাল । বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পরিবেশিত ও প্রস্তুতকৃত বিভিন্ন ধরনের খাবার ছাড়াও নিজের পরিবার অথবা আত্মীয়স্বজনদের জন্য বিভিন্ন ধরনের পানীয় , আচার , পিঠা ইত্যাদি তৈরি করা হয়ে থাকে ।

নবাবদের শাসন আমল সম্পাদনা :


বিভিন্ন সময়ে বঙ্গদেশ মুসলিম নবাব ও সুলতানদের অধীনে শাসিত হয়েছে । ১৭১৭ সালে মোগল শাসন আমলে এ অঞ্চলের শাসনভার নবাব মুর্শিদ কুলী জাফর খান এর হাতে ন্যস্ত করা হয় । মোগলদের শাসন আমলে স্বাভাবিকভাবেই মোগল সংস্কৃতি এবং সাহিত্যের পাশাপাশি রন্ধণপ্রণালী এবং খাদ্যাভাসের প্রভাব এ অঞ্চলে বসবাসরত বাঙালিদের উপর পড়ে । বর্তমান সময়েও বিভিন্ন মোগলাই খাবার যেমন : বাকরখানি , মোগলাই পরোটা , কাবাব , হালুয়া , বিরিয়ানী ইত্যাদি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ উভয় স্থানেই ব্যাপক জনপ্রিয় ।

বিধবা মহিলা রীতির প্রভাব সম্পাদনা :


বঙ্গ অঞ্চলে বিধবা মহিলাদের উপর সবসময়ই কঠোর নীতি চালু ছিলো । যদিও ১৮২৯ সালে সতীদাহ প্রথা রোধ ও ১৮৫৬ সালে হিন্দু বিধবা বিবাহ আইন এর মাধ্যমে এর অনেকটাই রোধ করা গেছে , তবুও কিছু কিছু সামাজিক আচার এখনও চালু রয়েছে । বাল্য বিবাহ এবং কম গড় আয়ুর ফলস্বরূপ অনেক মহিলাই বিধবাতে পরিণত হয় প্রায় ২৫ শতাংশ পরিবারে একজন বিধবা মহিলা রয়েছে , যারা বাড়ির ভিতরেই আবদ্ধ থাকে এবং রান্নাবান্নার কাজেই অধিক সময় ব্যয় করে থাকে । যদিও অধিকাংশ বাঙালি সম্প্রদায়ই মাছ মাংস খেতে পারত , বিধবা মহিলাদের জন্য এটা ছিল নিষিদ্ধ । এ কারণেই বিধবা মহিলাদের শুধুমাত্র নিরামিষ আহারের উপর নির্ভর করে নিরামিষ খাবার রান্নার এক বৃহৎ খাদ্য রেসিপি গড়ে উঠেছে । এ সম্পর্কে একজন বাঙালি লেখিকা চিত্রিতা ব্যানার্জী তার বইতে উল্লেখ করেন ।

রন্ধনপদ্ধতি এবং ব্যবহৃত দ্রব্যাদি সম্পাদনা :


বাঙালি খাবার রান্নার ক্ষেত্রে প্রধানত সরিষার তেল এবং সয়াবিন তেল ব্যবহৃত হয়ে থাকে । রান্নার ক্ষেত্রে প্রচলিত দ্রব্যাদি ও মশলা হচ্ছে হলুদ , মরিচ , আদা , রসুন , পেয়াজ , জিরা , লবঙ্গ , এলাচ , দারুচিনি ইত্যাদি । দৈনন্দিন আহারের ক্ষেত্রে সাধারণত প্রতিবেলার খাবার পৃথকভাবে কিছু ভাত অথবা রুটিসহ প্রস্তুতকৃত তরকারির সাথে ভোজন করা হয়ে থাকে ।

খাবারের অন্যতম পদসমূহসম্পাদনা – ইলিশ মাছের ঝোল/ভাজা । দৈনন্দিন আহারের ক্ষেত্রে ভাত , ডাল , ভর্তা , ভাজা , বাটা , শাক , শুক্তো , চচ্চোরি , পাাপোড় , মাছ ভাজা , মাছের তরকারি , সবজি , মাংস , ভূনা খিচুরি , পোলাও , লুুুচি , রুটি, পরোটা, দ‌ই , মিষ্টি , পায়েস ইত্যাদি প্রধান পদ হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে । বাঙালির প্রধান খাদ্য হচ্ছে ভাত । অর্থাৎ চাল থেকে প্রস্তুতকৃত ভাত ও ভাতজাতীয় খাদ্য বাঙালির খাদ্যতালিকায় মৌলিক চাহিদার স্থান দখল করেছে বলা যায় । চালকে সিদ্ধ করে তৈরি করা ভাত বাঙালি দৈনিক দুই কি তিনবেলা খেয়ে থাকে ।

 

চটকদার খাদ্য সম্পাদনা

বাঙালি সমাজে এমন অনেক খাদ্য প্রচলিত আছে , যেগুলো পুষ্টিগুণ বিবেচনায় ঠিক গ্রহণযোগ্য মাত্রার নয় , কিন্তু তবুও খাদ্য হিসেবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেশ আদৃত । এসকল খাদ্যকে একত্রে চটকদার খাদ্যের তালিকায় একত্রিত করা যায় । একপ্রকার ভাজা ঝাল খাবার । মুলত এটি ছোলার বা অড়হড় ডালের মিহি গুঁড়া থেকে তৈরি হয় । কখনও কখনও চানাচুর ঘি দিয়েও ভাজা হয়ে থাকে । এর সাথে যোগ করা হয় বিভিন্ন প্রকারের মশলা । দক্ষিণ এশীয়দের কাছে অসম্ভব জনপ্রিয় একটি নাস্তা । যেকোনো আড্ডা চানাচুর ছাড়া যেন চিন্তাও করা যায় না । চানাচুর বাঙালি সমাজে এতোটাই আদৃত যে , অধুনা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে বাণিজ্যিকভাবে চানাচুর উৎপাদন ও বিক্রয় করে থাকে এমনকি বহির্বিশ্বের বাঙালি সমাজে চানাচুর রপ্তানিও করা হয় ।

মুড়ি এবং গুড়কে একসাথে জ্বাল দিয়ে গোল পাকিয়ে মোয়া নামক এজাতীয় মিষ্টি তৈরি করা হয় । তবে কখনও কখনও খই বা মুড়কি দিয়েও মোয়া তৈরি হয় । ভারতের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের জয়নগরের মোয়া খুবই বিখ্যাত ।

সাধারণত নারকেল এবং গুড় একত্রে জ্বাল দিয়ে গোল পাকিয়ে তৈরি করা হয় নারু । যেমন তিলের নাড়ু । চিনি সহযোগে গোল পাকিয়েও নাড়ু তৈরি করা হয় । তবে নারকেল ও চিনি জ্বাল দিয়ে তাকে ক্ষীর দিয়ে পাকিয়ে যে নাড়ু তৈরি করা হয় তাকে বাঙালিরা রসকরা বলে । এটি নারকেলের নাড়ুর থেকে তুলনামূলক ভাবে নরম হয় । প্রত্যেক বাঙালি বাড়িতেই নাড়ু তৈরি হয়। বিশেষত বিজয়া দশমীর পর বাড়িতে আগত আত্মীয়-পরিজনকে নাড়ু, মোয়া , মিষ্টান্ন পরিবেশন করে বাঙালিরা সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়।মোরব্বাসম্পাদনা

মোরব্বা হলো খুব ঘন চিনির রসে ডোবানো একপ্রকার মিষ্টান্ন যা সাধারণত কোনো সবজিকে বিশেষভাবে জারিত করে প্রস্তুত হয় । যেমন : পেঁপের মোরব্বা , কুমড়োর মোরব্বা , পটলের মোরব্বা , শতমূলীর মোরব্বা ইত্যাদি ।
আলুকাবলিসম্পাদনা

আলুকাবলি বাংলার এক মুখরোচক খাবার । সিদ্ধ আলুর সাথে বিভিন্ন ধরনের মশলা মিশিয়ে এটি তৈরি হয় ।

আঞ্চলিক খাদ্য সম্পাদনা :


অঞ্চলভেদে স্থানভিত্তিক কিছু কিছু খাদ্য বাঙালির কাছে পরিচিত এবং তা ঐ অঞ্চলের ঐতিহ্যেরও একটা অংশ । এরকম কিছু খাদ্যের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি নিম্নে তুলে ধরা হলো :

সিদল – বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের বিশেষ করে গাইবান্ধা , কুড়িগ্রাম , নীলফামারী , লালমনিরহাট ও রংপুর অঞ্চলে বিশেষ পছন্দনীয় খাবার । বর্ষা মৌসুমে টাকিমাছ ও কচু ঢেঁকি বা সামগাইন দ্বারা একত্রে মিশিয়ে মুঠা বা চাকার মতো করে তৈরি করা হয় বাংগালি , তারপর তা শুকিয়ে তাওয়ায় ভেজে তেল , মরিচ , আদা , রসুন , এবং পেঁয়াজ একত্রে পিষে খাওয়া হয় ।

মিষ্টান্নসম্পাদনা – চমচম বাঙালিদের তৈরিকৃত মিষ্টান্ন গর্ববোধ করার মত । ভারতীয় উপমহাদেশে বিভিন্ন ধরনের মিষ্টান্ন তৈরি এবং উদ্ভাবনে বাঙালিরাই অগ্রদূত । রসগোল্লা , পানতোয়া , কালোজাম , সন্দেশ , নাড়ু , চমচম , সীতাভোগ , মিহিদানা , গজা , ক্ষীর , পায়েস , সেমাই , দই , নানা ধরনের পিঠা ইত্যাদি বাঙালিদের দ্বারা প্রস্তুতকৃত এবং জনপ্রিয় মিষ্টান্ন ।

জনপ্রিয় মাধ্যমে উপস্থাপনা সম্পাদনা :


বাঙালির খাদ্যপ্রীতির উপস্থিতি রয়েছে বাঙালির গণমাধ্যম গুলোতেও । ভারতের পশ্চিমবঙ্গের এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে বাংলার খাদ্য বিষয়ে আলাদা অনুষ্ঠান না হলেও রান্না বিষয়ক অনুষ্ঠানগুলোর প্রায় সিংহভাগ জুড়ে থাকে বাংলার বিভিন্ন খাদ্য । বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাংলার বিভিন্ন খাদ্য তৈরিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে উপস্থাপন করা হয় । এছাড়াও ভারতীয় চ্যানেলে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয় বাংলার বিভিন্ন খাদ্যকে ।

এছাড়াও বাঙালি খাবারের অন্তর্ভুক্ত রয়েছে বিভিন্ন ধরনের পানীয় যেমন সরবত , আখের রস , খজুরের রস , মালাই , লাচ্ছি , ফালুদা , বোরহানী , ঘোল , বেলের সরবত , চা , কফি ইত্যাদি ।

রান্না বিষয় আমাদের আর্টিকেল পড়ুন- 

৫ টি স্বাস্থ্যকর সালাদের রেসিপি 

সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন। আপনার মতামত আমাদের কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ, তাই কমেন্ট এর মাধ্যমে আপনার মতামত জানান। ধন্যবাদ।

     প্রিয়জানালা’র প্রিয় পাঠকঃ বাংলা ব্লগ, তথ্য ও প্রযুক্তি, সাধারণ জ্ঞান, বিজ্ঞান, খেলাধুলা, পড়াশুনা, বিউটি টিপস, স্বাস্থ্য টিপস, সিনেমা রিভিউ,  চাকরির গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলোর আপডেট পেতে এবং মতামত প্রকাশের জন্য আমাদের অফিসিয়াল ফেইসবুক পেইজ প্রিয়জানালা এ লাইক দিয়ে আমাদের সাথেই থাকুন। 

Back to top button